Saturday, November 28, 2015

বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব
প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ-বিশেষ করে বাংলা অঞ্চল ছিল ধন সম্পদে পূর্ণ রূপকথার মতো একটি দেশ। অঞ্চলের স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রাম অর্থাৎ মানুষের জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই তখন সব গ্রামগুলোতে পাওয়া যেত। এই স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামের কৃষকদের ক্ষেত ভরা ফসল, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ থাকত। কুটির শিল্পেও এই গ্রামগুলো ছিল সমৃদ্ধ। তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় ইউরোপের কাপড়ের চেয়েও উন্নতমানের ছিল। এর মধ্যে জগৎ বিখ্যাত ছিল মসলিন কাপড়। তাছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলও নানা ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য, মসলার জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব পণ্যের আকর্ষণেই অনেকেই এদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে এসেছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও উপমহাদেশে এসেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। পরবর্তী সময়ে তারা এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে পরাজিত করে এবং স্থানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র করে কিভাবে ইংরেজ ব্যবসায়ী কোম্পানী অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের সূচনা করে-বর্তমান অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
ইউরোপীয়দের আগমন
সাত শতক থেকে অঞ্চলের সঙ্গে আরব বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল একচেটিয়া। তারা বাণিজ্য করত মূলত সমুদ্রপথে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কন্সষ্টান্টিনপোল অটোমান তুর্কীরা দখল করে নেয়। ফলে উপমহাদেশের সাথে জলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভিন্ন জলপথ আবিষ্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মূলত কারণেই ইউরোপীয় শক্তিগুলো সমুদ্রপথে উপমহাদেশে আসার অভিযান শুরু করে।
পর্তুগীজ

পর্তুগীজদের মধ্যে যে দুঃসাহসী নাবিক প্রথম সমুদ্রপথে এদেশে আসেন তাঁর নাম ভাস্কো-ডা-গামা। তিনি ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২৭ মে ভারতের পশ্চিম-উপকূলের কালিকট বন্দরে এসে উপসি' হন। তাঁর উপমহাদেশে আগমন ব্যবসা- বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে।
পর্তুগীজরা ব্যবসা-বাণিজ্যকে মূলধন করে এদেশে আসলে ক্রমে ক্রমে তারা সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ইউরোপীয় বণিকরা উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলের কালিকট, চৌল, বোম্বাই, সালসেটি, বেসিন, কোচিন, গোয়া, দমন, দিউ প্রভৃতি বন্দরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে তারা চট্টগ্রাম সাতগাঁওয়ে শুল্কঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি লাভ করে। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে হুগলী নামক স্থানে তারা উপনিবেশ গড়ে তোলে। এরপর তারা উড়িষ্যা এবং বাংলার কিছু অঞ্চলে বসতি সমপ্রসারিত করতে সক্ষম হয়। বাংলাসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও পর্তুগীজদের বিভিন্ন অপকর্ম দস্যুতার কারণে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান তাদের চট্টগ্রাম সন্দ্বীপের ঘাঁটি দখল করে বাংলা থেকে বিতাড়ন করেন। তাছাড়া পর্তুগীজরা এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বীতায় পরাজিত হয়। ফলে এরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

ওলন্দাজ বা ডাচ

হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজ বা ডাচরাডাচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগঠন করে বাণিজ্যির উদ্দেশে ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে এই উপমহাদেশে আসে। ভারতবর্ষে তারা কোম্পানির সনদ অনুযায়ী কালিকট, নাগাপট্টম বাংলার চুঁচুড়া বাকুড়ায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাছাড়া বলাসোর কাশিমবাজার এবং বরানগরেও তারা কুঠি স্থাপন করে। ওলন্দাজ অপর ইউরোপীয় শক্তি ইংরেজদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ শুরু হয় এবং একই সঙ্গে বাংলার শাসকদের সঙ্গে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত বিদারার যুদ্ধে তারা ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে তারা সকল বাণিজ্য কেন্দ্র গুটিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। প্রথমে পতুর্গীজ পরে ওলন্দাজ শক্তির পতন, ভারতে ইংরেজ শক্তির উত্থানের পথ সুগম করে।
দিনেমার

দিনেমার বা ডেনমার্কের অধিবাসী একদল বণিক বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যেডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগঠন করেন। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে তারা দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর জেলায় ত্রিবাঙ্কুর এবং ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন। কিন্তু এদেশে তারা লাভজনক ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয়। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছে বাণিজ্য কুঠি বিক্রি করে কোনো রকম বাণিজ্যিক সফলতা ছাড়াই দিনেমাররা এদেশ ত্যাগ করে।
ইংরেজ

সমুদ্রপথে ইউরোপীয় বণিকদের সাফল্য, প্রাচ্যের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, ইংরেজ বণিকদেরকেও অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহিত করে। এই উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বণিক সংঘ গড়ে তোলে। বণিক সংঘটি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি প্রাচ্যে একচেটিয়া বাণিজ্য করার সনদপত্র লাভ করে। এই সনদপত্র নিয়ে কোম্পানির প্রতিনিধি বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের আশায় আকবরের দরবারে হাজির হন। এরপর ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে বাণিজ্য সমপ্রসারণের লক্ষ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম জেমসের দূত হয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন স্যার টমাস রো। সম্রাটের কাছ থেকে তিনি ইংরেজদের জন্য বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন। ১৬১৯ খ্রিঃ তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে কোম্পানি সুরাট আগ্রা, আহমদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তাদের ভিত্তি মজবুত করে ফেলে।
কোম্পানি তার দ্বিতীয় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে মসলিমপট্টমে। এরপর বাংলার বালাসোরে আরেকটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। এদের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে এরা করমণ্ডল (মাদ্রাসা শহর) উপকূলে একটি দুর্গ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। বাংলার সুবেদার শাহ সুজার অনুমোদন লাভ করে তারা ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। এভাবে কোম্পানি কাশিমবাজার, ঢাকা, মালদহেও বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে।
১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগীজ রাজকন্যা ক্যাথরিনের সঙ্গে বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন বোম্বাই শহর। অর্থাভাবে চার্লস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে শহরটি বিক্রি করে দেন। পরবর্তীকালে এই বোম্বাই শহরই কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়।
জব চার্ণক নামে আরেকজন ইংরেজ ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ১২০০ টাকার বিনিময়ে কোলকাতা, সুতানটি গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারী স্বত্ত্ব লাভ করেন। ভাগীরথী নদীর তীরের এই তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে কোলকাতা নগরীর জন্ম হয়। এখানেই কোম্পানি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নাম অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে। ধীরে ধীরে এটি ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তারের শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় যখন দিল্লির সম্রাট ফারুখশিয়ার তাদের বাংলা, বোম্বাই মাদ্রাজে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। একই সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকারও কোম্পানি লাভ করে। সম্রাটের এই ফরমানকে ইংরেজ ঐতিহাসিক ওরমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহাসনদ বা ম্যাগনা কার্টা বলে উলে- করেন। এইখ অধিকার লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপ্রতিরুদ্ধ গতিতে অগ্রসর হতে থাকে।

ফরাসী

উপমহাদেশে সর্বশেষে আগত ইউরোপীয় বণিক কোম্পানি হচ্ছে ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠিত হয়। ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি সর্বপ্রথম সুরাট এবং পরের বছর মুসলিমপট্টমে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন। ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে পন্ডিচেরীতে ফরাসী উপনিবেশ গড়ে ওঠে।
১৬৭৪ খ্রিঃ পর থেকে তারা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাংলায় সমপ্রসারিত করে। কোম্পানির বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর তীরে অবসি' চন্দননগর নামক স্থানটি কিনে নেয়। ১৬৯০ থেকে ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চন্দননগর একটি শক্তিশালী সুরক্ষিত ফরাসী বাণিজ্য কুঠিতে পরিণত হয়। ১৬৯৬ খ্রিঃ কোম্পানি এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদানের শর্তে ১৬৯৩ খ্রি: ফরাসীর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। পরবর্তীকালে তারা কাশিমবাজার বালাসোরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
ইংরেজ বণিকরা যখন ব্যবসা বাণিজ্যে দৃঢ় অবস্থানে তখন ফরাসীরা এদেশে আসে। অবস্থায় ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির মতো ফরাসীরাও এদেশে সম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ফলে দুই ইউরোপীয় শক্তি- ইংরেজ ফরাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, কূটকৌশল, উন্নত রণ কৌশলের কাছে ফরাসীরা পরাজিত হয়। বাংলার নবাবের পক্ষ অবলম্বন করায় ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্য তাদেরকে আরও পর্যুদস্ত করে ফেলে। ফলে বাংলার ফরাসী কুঠিগুলো ইংরেজদের দখলে চলে যায়। দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকের যুদ্ধসমূহে ফরাসী কোম্পানি পরাজিত হলে তারা এদেশ ত্যাগ করে। ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়।

পলাশী যুদ্ধ

১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আলীবর্দী খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। প্রতিকূল পরিসি'তিতেও তিনি সফলভাবে রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি তাঁর সময়ে মারাঠা বর্গীদের দমন করে রাখতে সফল হন। সুকৌশলে ইংরেজ বণিক কোম্পানিকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
নবাব মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান। ১৭৫৬ খ্রিঃ আলীবর্দী খানের মৃত্যু হলে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা ২২ বছর বয়সে নবাবের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সিংহাসনে বসার পর থেকে তাকে নানামুখী ষড়যন্ত্র সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। তাঁর প্রথম সমস্যা ছিল তাঁর পরিবারে ঘনিষ্ঠজনদের ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে আলীবর্দী খানের তিন কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘষেটি বেগম সিরাজের নবাব হওয়ায় আশাহত হয়ে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এদের সঙ্গে যোগ দেন ঘাষেটি বেগমের দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ , পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা সিরাজের খালাতো ভাই শওকত জঙ্গ এবং অন্যান্যরা। কৌশলে নবাবভ ঘষেটি বেগমকে নজরবন্দী করেন। পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সিরাজউদ্দৌলা এক যুদ্ধে তাকে পরাজিত নিহত করে পূর্ণিয়া দখল করে নেন।
নবাব পারিবারিক ষড়যন্ত্র কৌশলে দমন করলেও তাঁর বিরুদ্ধে বাইরে ষড়যন্ত্রের আরেক জাল বিস-ৃত হতে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত হয় দেশি-বিদেশি বণিক শ্রেণি, নবাবের দরবারের প্রভাবশালী রাজন্যবর্গ অভিজাত শ্রেণি, নবাবের সেনাপতি মীর জাফরসহ আরো অনেকে। প্রত্যেকে যার যার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করতে থাকে।

পলাশী যুদ্ধের কারণ

ইতিহাসের যেসব ঘটনা একটি দেশের জনগণের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে, পলাশীর যুদ্ধ অঞ্চলের জনগণের জন্য তেমনি এক ঘটনা ছিল। এই ঘটনার পেছনের কারণগুলো নিম্নে উলে- করা হলো।
  • প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা সিরাজউদৌলা বাংলার সিংহাসনে বসারা পর নতুন নবাবকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি এবং কোনো সৌজন্যমূলক সাক্ষাতও করেনি। ইংরেজদের এই বেয়াদবিতে নবাব ক্ষুব্ধ হন।
  • নবাবের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত রাখে।
  • ইংরেজ কোম্পানি দস্তকের অপব্যবহার করলে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রসত হতে থাকে। নবাব দস্তকের অপব্যবহার করতে নিষেধ করেন এবং বাণিজ্যিক শর্ত মেনে চলার আদেশ দেন। কোম্পানি নবাবের সে আদেশও অগ্রাহ্য করে।
  • আলীবর্দী খানের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ইংরেজরা নবাবকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাছাড়া জনগণকে নির্যাতন করার মতো ধৃষ্টতাও তারা দেখাতে থাকে।
  • রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস তার পরিবারের সদস্যদেরসহ প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে কোলকাতায় ইংরেজদের কাছে আশ্রয় নেয়। তাকে ফেরত দেয়ার জন্য নবাব ইংরেজদের নিকট দূত পাঠান। ইংরেজ গভর্নর নবাবের দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। এর আগে শওকত জঙ্গের বিদ্রোহের সময়ও ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়
ইংরেজদের একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, অবাধ্যতা নবাবকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৭৫৬ খ্রিঃ জুন মাসের শুরুতে নবাব কোলকাতা দখল করে নেন। যাত্রা পথে তিনি কাশিম বাজার কুঠিও দখল করেন। নবাবের অতর্কিত আক্রমণে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। হলওয়েলসহ বেশকিছু ইংরেজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে নবাবকে হেয় করার জন্য হলওয়েল এক মিথ্যা কাহিনীর প্রচারণা চালায় যা ইতিহাসেঅন্ধকূপ হত্যানামে পরিচিত। এতে বলা হয় যে, ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ১৪.১০ ফুট প্রস' ছোট একটি ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখা হয়। এতে প্রচণ্ড গরমে শাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। এই মিথ্যা প্রচার মাদ্রাজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে উত্তেজিত হয়ে কোলকাতা দখল করার জন্য ওয়াটসন ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় চলে আসে। তারা নবাবের সেনাপতি মানিকচাঁদকে পরাজিত করে কোলকাতা দখল করে নেয়। নবাব তাঁর চারদিকে ষড়যন্ত্র শত্রু পরিবেষ্টিত টের পেয়ে ইংরেজদের সঙ্গে নতজানু অপমানজনক সন্ধি করতে বাধ্য হন। ইহা ইতিহাসে আলীনগর সন্ধি নামে খ্যাত।
আলীনগর সন্ধিতে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর ক্লাইভের উচ্চাকাঙ্খা আরো বৃদ্ধি পায়। নবাবের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজরা ফরাসীদের চন্দনগর কুঠি দখল করে নেয়। নবাব অবস্থায় ফরাসীদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে ইংরেজদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এতে ক্লাইভ ক্ষুব্ধ হয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই ষড়যন্ত্রে ক্লাইভের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসায়ী ধনকুবের জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ সেনাপতিরভ মীরজাফর প্রমুখ।

পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা

পলাশীর যুদ্ধ বাংলা তথা উপমহাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৭৫৭ খ্রিঃ ২৩ জুন ভগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতোমধ্যে রবার্ট ক্লাইভ তার অবস্থান সুদৃঢ় করে সন্ধিভঙ্গের অজুহাতে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নবাবের পক্ষে দেশপ্রেমিক মীরমদন, মোহন লাল এবং ফরাসী সেনাপতি সিন ফ্রে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে মীরমদন নিহত হন। নবাবের বিজয় আসন্ন জেনে মীরজাফর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। মীর মদনের মৃত্যু মীরজাফরের অসহোযোগিতা নবাবকে বিচলিত করে।
নবাবের সেনাপতি মীরজাফর যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করে নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। নবাব কোরআন স্পর্শ করিয়ে শপথ নেয়ালেও মীরজাফরের ষড়যন্ত্র থামেনি। নবাবের সৈন্যরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছে সেই সময় মীরজাফরের ইঙ্গিতে ইংরেজ সৈন্যরা তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতি নবাবের পরাজয়।

নবাবের পতনের কারণ
  • নবাবের সেনাপতি মীরজাফর তার সহযোগীদের যুদ্ধক্ষেত্রে অসহোযোগিতা বিশ্বাসঘাতকতা।
  • নবাবের সেনাপতি থেকে সভাসদ পর্যন্ত সবাই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, ব্যক্তি স্বার্থকে বড় করে দেখেছে।
  • তরুণ নবাবের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা দৃঢ়তার অভাব ছিল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্তগ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
  • সেনাপতি মীরফাজরের ষড়যন্ত্রের কথা জানা সত্ত্বেও তিনি বার বার তার উপরই নির্ভর করেছেন।
  • ইংরেজদের সম্পর্কে সতর্কতা, ফরাসী এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্র এসব বিষয়ে আলীবর্দী খানের উপদেশ সিরাজউদ্দৌলার কাছে গুরুত্ব পায়নি।
  • নবাবের শত্রু পক্ষ ছিল ঐক্যবদ্ধ এবং রণকৌশল ছিল উন্নততর।
  • রবার্ট ক্লাইভ ছিল দূরদর্শী, সুক্ষ্ম কূট বুদ্ধিসম্পন্ন
পলাশী যুদ্ধের ফলাফল
  • সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় মৃত্যু বাংলায় প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের পথ সুগম করে।
  • যুদ্ধের ফলে মীরজাফরকে বাংলার সিংহাসনে আরোহণে বসালেও তিনি ছিলেন নামেমাত্র নবাব, প্রকৃত ক্ষমতাছিল রবার্ট ক্লাইভের হাতে।
  • পলাশী যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ফরাসীরা এদেশ থেকেবিদায় নিতে বাধ্য হয়।
  • যুদ্ধের পর ইংরেজ শক্তির স্বার্থে এদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন সংঘটিত হতে থাকে।
  • পলাশী যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী পরিণতি ছিল সমগ্র উপমহাদেশে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা। এভাবেই যুদ্ধের ফলেবাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, পলাশীর যুদ্ধ একটি খণ্ডযুদ্ধ হলেও বাংলা তথা উপমহাদেশর রাজনীতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪)

ইংরেজ বণিক কোম্পানি মীর জাফরকে যে উদ্দেশে সিংহাসনে বসিয়েছিল তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। নতুন নবাব কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। নিজের ক্ষমতা রক্ষা করতেও তাকে বার বার ক্লাইভের উপর নির্ভর করতে হয়। আবার ক্লাইভের রাজকার্যে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ নবাবের পছন্দ ছিল না। ইংরেজদের বিতাড়নের জন্য মীর জাফর আরেক বিদেশি কোম্পানি ওলান্দাজদের সাথে আঁতাত করে। বিষয়টি ইংরেজদের দৃষ্টি এড়ায়নি। মীর জাফরের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে অক্ষমতা এবং ওলন্দাজদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ১৭৬০ খ্রিঃ ইংরেজ গভর্নর ভান্সিটার্ট মীরজাফরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মীর কাশিমকে শর্ত সাপেক্ষে সিংহাসনে বসান। মীর কাশিমের স্বাধীন নবাব হিসেবে টিকে থাকার ইচ্ছার কারণে মূলত বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

বক্সারের যুদ্ধের কারণ :
মীর কাশিম একজন সুদক্ষ শাসক, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর প্রজাদের কল্যাণের প্রতি সচেতন ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে সম্মানজনক উপায়ে বাংলার স্বার্থ রক্ষা করে আর্থিক সামরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে। উদ্দেশে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলাই শেষ পর্যন্ত বক্সারের যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • মীর কাশেম প্রথমে ইংরেজদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপবন্ধ এবং প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উদ্দেশে তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গের স্থানান্তরিত করেন। নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ রাজধানীর চারদিকে পরিখা খনন করেন।
  • ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা এবং সৈনিকদের ইউরোপীয় সামরিক পদ্ধতি শিক্ষাদানের জন্য দুজন ইউরোপীয় সৈনিককে প্রশিক্ষক হিসেবে রাখেন।
  • অস্ত্র-গোলাবারুদের জন্য যাতে কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয় সেজন্য রাজধানীতে কামান, বন্দুক ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা নেন।
  • বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণ ইংরেজদের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখালে তাকে পদচ্যুত তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
  • ১৭১৭ খ্রিঃ মুঘল সম্রাটের ফরমানে ইংরেজদের ব্যবসা করার যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তারা তার অপব্যবহার করা শুরু করে।দস্তকনামের ছাড়পত্রের অপব্যবহারের ফলে দেশি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস' হতে থাকে। ফলে, নবাব সবার জন্য এক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আন্তঃবাণিজ্যে সকল শুল্ক উঠিয়ে দেন। ফলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের একচেটিয়া লাভজনক ব্যবসায় অসুবিধা হয়। বিষয়ে নবাব কোনোরকম আপোষ করতে না চাইলে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
  • নবাবের সকল পদক্ষেপ ছিল দেশ জনগণের স্বার্থে, কিন্তু ইংরেজ স্বার্থবিরোধী। ফলে ক্ষুব্ধ ইংরেজরা এর প্রতিকারের জন্য প্রস' হচ্ছিল।
  • ১৭৬৩ খ্রিঃ ক্ষুব্ধ হয়ে পাটনা কুঠির অধ্যক্ষ এলিস পাটনা আক্রমণ করে দখল করে নেয়। ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা ছাড়া নবাবের আর কোনো উপায় থাকে না। মীর কাশিম সফল প্রতিরোধের মাধ্যমে এলিসকে পাটনা থেকে বিতাড়িত করেন। ১৭৬৩ খ্রিঃ কোলকাতা কাউন্সিল নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মেজর এডামসের নেতৃত্বে প্রেরিত ইংরেজ বাহিনীর কাছে গিরিয়া, কাটোয়া উদয়নালার যুদ্ধে নবাব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন
ইতোমধ্যে ইংরেজরা মীর জাফরকে পুনরায় বাংলার সিংহাসনে বসায়। মীর কাশিম পরাজিত হয়েও হতাশ হননি। নবাব ইংরেজদের মোকাবেলার জন্য প্রস'তি গ্রহণ করতে থাকেন। তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ১৭৬৪ খ্রি: বিহারের বক্সার নামক স্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে চরম শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। দুর্ভাগ্যক্রমে সম্মিলিত বাহিনী মেজর মনরোর কাছে চরমভাবে পরাজিত হয়।
মীর কাশিমের পরাজয়ের কারণে বাংলার সার্বভৌমত্ব উদ্ধারের শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইংরেজ শক্তি অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলা তথা উপমহাদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে থাকে। কারণে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধের চেয়ে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি।

বক্সার যুদ্ধের ফলাফল :
এক. যুদ্ধের ফলে মীর কাশিমের স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। উপমহাদেশে ইংরেজদের প্রভাব প্রতিপত্তি মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিনা বাধায় তারা উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে।
দুই. যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে যান। দিল্লির সম্রাট শাহ আলমী ইংরেজদের পক্ষে যোগ দেন। মীর কাশিম পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন। ১৭৭৭ খ্রিঃ তাঁর মৃত্যু হয়।
তিন. ইংরেজরা অযোধ্যার নবারের কাছ থেকে কারা এলাহাবাদ হস্তগত করতে সক্ষম হয়।
চার. যুদ্ধের ফলে শুধু বাংলার নবাবই পরাজিত হননি, তাঁর মিত্র ভারত সম্রাট শাহ আলম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাও পরাজিত হন। এই তিন শক্তির একসঙ্গে পরাজয় ইংরেজদের মর্যাদা শক্তি বৃদ্ধি পায়।
পাঁচ. যুদ্ধের ফলে রবার্ট ক্লাইভ দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দিওয়ানী লাভী করে। ফলে বাংলায় ইংরেজ অধিকার আইনত স্বীকৃত হয় এবং তারা অসীম ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে থাকে।
বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমের পরাজয় শুধু নবাবী আমলেরই পরিসমাপ্তি ঘটায়নি, মুঘল সম্রাটের দুর্বলতাও ইংরেজদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে দ্রুতগতিতে ইংরেজদের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে।

কোম্পানির দেওয়ানী লাভ

১৭৬৫ খ্রি: মীর জাফরের মৃত্যুর পর তার পুত্র নাজিম-উদ-দৌলাকে শর্ত সাপেক্ষে বাংলার সিংহাসনে বসানো হয়। শর্ত থাকে যে তিনি তার পিতার মতো ইংরেজদের নিজস্ব পুরাতন দস্তক অনুযায়ী বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য করতে দিবেন এবং দেশীয় বণিকদের অবাধ বাণিজ্যের সুবিধা বাতিল করে দিবেন। বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলায় ইংরেজ শাসনের পথ সুগম হয়। সময়ে ইংরেজ কোম্পানি মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলার রাজস্ব আদায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্থাৎ দেওয়ানী লাভ করে। ১৭৬৫ খ্রিঃ দেওয়ানি লাভের পর প্রকৃতপক্ষে ইংরেজরাই বাংলার সত্যিকার শাসকরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
মুঘল শাসনাধীন বাংলার দেওয়ানের পদ এবং সুবেদার পদ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত ছিল। মুর্শিদ কুলি খান এই প্রথা ভঙ্গ করে দুটি পদ একাই দখল করে নেন। তাঁর সময় কেন্দ্রে নিয়মিত রাজস্ব পাঠানো হলেও পরবর্তীকালে অনেকেই তা বন্ধ করে দেন। আলীবর্দী খানের সময় থেকে একবারেই তা বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট কোম্পানিকে বাৎসরিক উপঢৌকনের বদলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী গ্রহণের অনুরোধ করেন। কিন্তু এই অনুরোধ কোম্পানি তখন গ্রাহ্য করেনি। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ খ্রিঃ ক্লাইভ দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে আসলে পরিসি'তি পাল্টে যায়।
ক্লাইভ দেশ থেকে ফিরে প্রথমেই পরাজিত অযোধ্যার নবাব এবং দিল্লির সম্রাটের দিকে নজর দেন। তিনি অযোধ্যারী পরাজিত নবাবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। তার বিনিময়ে আদায় করে নেন কারা এলাহাবাদ জেলা দুটি। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করেন পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। অপর দিকে দেওয়ানী শর্ত সম্বলিত দুটি চুক্তি তিনি করেন। একটি দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে। এতে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী দান করা হয়। এর বিনিময়ে ছাব্বিশ লক্ষ টাকা নবাব প্রতিবছর সম্রাটকে পাঠাবেন। এই টাকা নিয়মিত পাঠাবার জামিনদার হবে কোম্পানি।
অপর চুক্তিটি হয় মীর জাফরের নাবালক পুত্র নবাব নাজিম-উদ-দ্দৌলার সঙ্গে। বাৎসরিক ৫৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নবাব কোম্পানির দেওয়ানী লাভের সকল শর্ত মেনে নেন। এই চুক্তিদ্বয়ের ফলে যে দেওয়ানী লাভ করা হয় তাতে অঞ্চলে কোম্পানির ক্ষমতা একচেটিয়া বৃদ্ধি পায়। নবাব এখন বস' কোম্পানির পেনশনার মাত্র। সম্রাটও তাই। সমস্ত ক্ষমতা কোম্পানির হাতে। দেওয়ানীর ফলে কোম্পানির যে আয় হবে তা দিয়ে কোম্পানির সমস্ত খরচ কুলিয়ে ব্যবসার সমস্ত পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব। সুতরাং, দেওয়ানীর গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে হয় যে,
এক. দেওয়ানী লাভ কোম্পানির শুধু রাজনৈতিক নয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশাল বিজয়।
দুই. সম্রাট নবাব উভয়েই ক্ষমতাহীন শাসকে পরিণত হন। প্রকৃতপক্ষে তারা হয়ে যান কোম্পানির পেনশনভোগী কর্মচারী।
তিন. দেওয়ানী লাভের ফলে এবং নবাব কর্তৃক প্রদত্ত শর্ত অনুযায়ী শুল্কহীন বাণিজ্যের কারণে কোম্পানির কর্মচারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের অর্থ লোভ দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। ক্ষতিগ্রসত হতে থাকে দেশীয় বণিক শ্রেণি, সাধারণ মানুষ। তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
চার. দেওয়ানী লাভের ফলে বাংলা থেকে প্রচুর অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে। এর পরিমাণ এতটাই ছিল যে এই অর্থের বলে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ-বর ক্ষেত্র প্রস' হয়েছিল।

দ্বৈত শাসন

রবার্ট ক্লাইভ দেওয়ানী সনদের নামে বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের একচেটিয়া ক্ষমতা লাভ করে। দিল্লি কর্তৃক বিদেশি বণিকী কোম্পানিকে এই অভাবিত ক্ষমতা প্রদানে সৃষ্টি হয় দ্বৈত শাসনের। অর্থাৎ যাতে করে কোম্পানি লাভ করে দায়িত্বহীন ক্ষমতা, নবাব পরিণত হন ক্ষমতাহীন শাসকে। অথচ নবাবের দায়িত্ব থেকে যায় ষোলআনা। ফলে বাংলায় এক অভূতপূর্ব প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি যার চরম মাসুল দিতে হয় এদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) গ্রীষ্মকালে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যা স্মরণকালের ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। কোম্পানির মুর্শিদাবাদের প্রতিনিধি রিচার্ড বেচারের ভাষায়দেশের কয়েকটি অংশে যে জীবিত মানুষ মৃত মানুষকে ভক্ষণ করিতেছে তাহা গুজব নয়, অতি সত্য এই দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
১৭৬৫-৭০ খ্রিঃ বাৎসরিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ যা ছিল, দুর্ভিক্ষের বছরও আদায় প্রায় তার কাছাকাছি ছিল। ফলে চরম শোষণ নির্যাতনে বাংলার মানুষ হতদরিদ্র অসহায় হয়ে পড়ে। দ্বৈতশাসন ব্যবস্থায় নবাবের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় প্রশাসন পরিচালনায় তিনি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন। সারাদেশে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। এই পরিসি'তিতে ১৭৭২ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটান।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

লর্ড কর্ণওয়ালিসকে কোম্পানির শাসন দুর্নীতিমুক্ত সুসংগঠিত করতে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গভর্নর জেনারেল সেনা প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৯৩ খ্রিঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বছর ২২ মার্চ নির্দিষ্ট রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারগণকে নিজ নিজ জমির উপর স্থায়ী মালিকানা দান করে যে বন্দোবস্ত চালু করা হয় তাকেইচিরস্থায়ী বন্দোবস্তবলা হয়।
পটভূমি: ১৭৭২ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এই ব্যবস্থায় উচ্চহারে ডাক নিয়ে জমির বন্দোবস্ত নিলেও সে অনুপাতে রাজস্ব আদায় হতো না। নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকায় জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনে নির্যাতন করে অর্থ আদায় করত। অথচ কৃষকদের উন্নয়ন বা জমির উন্নয়নের প্রতি তাদের কোন লক্ষ ছিল না। ফলে নির্যাতনের ভয়ে কৃষকরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেত। বছরের পর বছর জমি অনাবাদী থাকায় জমির দাম কমে যেত। অবস্থায় হেস্টিংস জমিদারদের সঙ্গে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। কিন্তু ব্যবস্থায়ও সরকার, জমিদার, প্রজা- কারো কোনো ধরনের উপকার হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট নতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। ১৭৮৪ খ্রিঃ পিটের ইন্ডিয়া এ্যাক্ট পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় স্থায়ী নিয়ম-কানুন প্রবর্তনের মাধ্যমে দির্ঘমেয়াদি রাজস্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭৮৯ খ্রিঃ কর্ণওয়ালিস জমিদারদের দশশালা বন্দোবস্ত দিতে প্রস'তি নেন। ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্তের অনুমতি প্রদান করলে কর্ণওয়ালিস এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮৯ খ্রিঃ দশসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। তবে এর সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন যে, কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন পেলে দশসালা বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হবে। ১৭৯২ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে বোর্ড অব ডাইরেক্টরস কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। ১৭৯৩ খ্রিঃ কর্ণওয়ালিস ২২ মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করেন।
বৈশিষ্ট্য
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদেরকে জমির স্থায়ী মালিকে পরিণত করে এবং জমিদারগণ জমির মালিকানা স্বত্ব লাভ করে।
  • রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে জমিদার জমিদারী ভোগের চিরস্থায়ী অধিকার লাভ করে।
  • প্রথা চালু হওয়ার ফলে জমিদারদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। সরকার স্বয়ং শান্তি রক্ষা নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
  • নজরানা বিক্রয় ফি সমূহ বাতিল করা হয়।
  • খাজনা বাকি পড়লে জমিদারদের ভূমির কিছু অংশ বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা ছিল
ফলাফল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কর্ণওয়ালিস জমিদার ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের মতো এদেশেও একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপ আর উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো তার বিকাশের ধরন এক ছিল না। ফলে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই অধিক পরিলক্ষিত হয়।
সুবিধা :
  • ব্যবস্থার প্রধান সুবিধা হচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয় সুনির্দিষ্ট হওয়ার ফলে সরকার তার আয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। যে কারণে বাজেট প্রণয়ন, বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়।
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি কোম্পানির একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে উঠে। ফলে ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়করণ এবং দীর্ঘায়িতকরণে জমিদাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
  • জমির উপর জমিদারের স্থায়ী মালিকানা স্বীকৃত হওয়ার কারণে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হন। তারা নিজ নিজ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয়, উপাসনালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া প্রজাদের কল্যাণের জন্য রাস্তাঘাট, পুল তৈরি, পুকুর খননের মতো কাজ ছাড়াও অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁরা জড়িত হন।
  • জমিদাররা জমির মালিক হওয়ার কারণে উৎসাহিত হয়ে পতিত জমি, জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষের ব্যবস্থা করেন। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়।
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সরকারকে জনপ্রিয় করে তোলে, আবার জমিদার শ্রেণি কর্তৃক সামাজিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখার কারণে পরিবর্তিত হতে থাকে গ্রামীণ সমাজ
দোষ :
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। তারা ধীরে ধীরে ধনীক শ্রেণিতে পরিণত হয়। কিন্তু অপর দিকে জমিতে প্রজাদের পুরোনো স্বত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। ফলে জমিদার ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত। প্রথম দিকে প্রজাস্বত্ব আইন না থাকায় তাদের ভাগ্যের জন্য তারা সম্পূর্ণভাবেই জমিদারের দয়ার উপর নির্ভর করতো।
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমির সঠিক জরিপের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় নিষ্কর জমির উপর বেশি রাজস্ব ধার্য করা হতো। জমির সীমা নির্ধারিত না থাকায় পরবর্তীকালে মামলা বিবাদ দেখা দিত।
  • সূর্যাস্ত আইনে নির্দিষ্ট তারিখে সূর্যাস্তের মধ্যে খাজনা পরিশোধ বিধানের কঠোরতার কারণে অনেক বড় বড় জমিদারী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একমাত্র বর্ধমানের জমিদারী ছাড়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাত বছরের মধ্যে অন্যান্য সব জমিদারী ধ্বংস হয়ে যায়।
  • জমিদারী আয় স্বত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে জমিদাররা নায়েব-গোমস্তার উপর দায়িত্ব দিয়ে শহরে বসবাস শুরু করেন। এইসব অনুপসি' জমিদারদের নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচারে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ফলে জমির উৎপাদন কমে যেতে থাকে, গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে।
  • উপমহাদেশে জমি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ফলে নিম্নবর্ণের অনেক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ যারা কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থের মালিক হন, তারা জমিদারী কিনে আভিজাত্যের মর্যাদালাভে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফলে দেশীয় পুঁজি, দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যায়। অপর দিকে কোম্পানিও সম্ভাব্য এদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে বেঁচে যায়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকরা সরাসরি জমিদার কর্তৃক শোষিত হতে থাকে। আবার এই জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে গ্রামীণ সমাজে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠছিল, যারা পরবর্তী সময়ে দেশ-জাতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি যারা প্রথমদিকে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের শক্ত ভিত ছিল, তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ-রাজ উৎখাতের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে


0 comments:

Post a Comment